Sylhet 12:22 pm, Monday, 6 January 2025

টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) থেকে:

অবশেষে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি। বৃহস্পতিবার(০২ জানুয়ারী) বিকেলে হাওর তীরবর্তী জনপদে আকাশ থেকে ভেসে আসে ভিন্ন ধরনের শোঁ শোঁ আওয়াজ।চলতি বছরে এইপ্রথম ঝাঁক বেঁধে আসতে দেখা গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরের মেহমান পরিযায়ী পাখিদের। স্থানীয়রা এসব পাখিদের আদরকরে ডাকেন অথিতি পাখি। পাখিদের আগমনে এই জনপদের নানা বয়সী মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে আনন্দ আর উচ্ছাসের।
বাংলাদেশে টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখির সর্বোচ্চ উপস্থিতি দেখা যায়। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুর দুইটি উপজেলা১২৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি হলেও এর ৬০-৬৫ ভাগ মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থিত। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপন্ন এ জলাভূমিটি রামসার নীতিমালা অনুযায়ী সংরক্ষিত এলাকা। সুন্দরবনের পরে এটি দ্বিতীয় রামসার সাইট।
তবে ভৌগলিক অবস্থান ও জলাভূমির জীব-বৈচিত্র্য, এর সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাস, বিশ্বের বিরল প্রজাতির পাখির আবাসস্থল, বিপুল সংখ্যক পরিয়ায়ী পাখীর উপস্থিতি, দূর্লভ জলজ বৃক্ষ গুল্মলতা রয়েছে এ সব বিবেচনায় ইউনেস্কো এ জলাভূমিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) টাঙ্গুয়ার হাওরে জীব-বৈচিত্র্য পুনোরুদ্ধারে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। সংস্থাটি টাঙ্গুয়ার হাওরের বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিল নামের দুইটি জলাশয় পরিযায়ী ও দেশীয় পাখির অভয়াশ্রম নির্ধারন করে কোর জোনের আওতাভুক্ত করেছে। এ দুইটি জলাশয় মধ্যনগর উপজেলার ভৌগলিক সীমায় অবস্থিত। প্রতি বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা পাখি দিনের বেলায় হাওরজুড়ে বিচরন করলেও সন্ধ্যায় বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিলে এসে নির্ভয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে।

পরিযায়ী পাখি মূলত তীব্র শীত ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল দূরের পথ উড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। ওরা আসতে শুরু করে নভেম্বরে। এপ্রিল পর্যন্ত থাকে। এবার প্রায় একমাস দেরীতে টাঙ্গুয়ার হাওরে এলো পরিযায়ী পাখি।

বিশ্বের যেসব দেশ থেকে পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে এর মধ্যে রয়েছে মঙ্গোলিয়া, চীন, তিব্বত, ভারত,নেপাল, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়া,ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ার, সাইবেরিয়া ও এন্টার্টিকা।

পাখি বিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতিগতভাবেই পরিযায়ী পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত। এরা সাধারণত ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। ছোট পাখিদের ঘণ্টায় গতি ৩০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে ওড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব পাখি তাদের গন্তব্যস্থান ঠিকভাবেই নির্ণয় করে। প্রতিটি পরিযায়ী পাখি গড়ে আট হাজার মাইল ভ্রমণ করে বাংলাদেশে আসে। এরা ২০০ থেকে ২৩০ দিন এ দেশে অবস্থান করে তারা। হাওর এলাকা এসব পাখির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। হাওরে দেড়-দুই লাখ পরিযায়ী পাখি আসে। যার সর্বোচ্চ পরিমান পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে অবস্থান নেয়।

পাখি গবেষক ও তাদের গবেষনা সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১ হাজার ৮৫৫ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এর মধ্যে হাঁস প্রজাতির ২৪টি, শিকারি পাখি ৩২টি, শীত মৌসুমের পাখি রয়েছে ২০০ প্রজাতি, গ্রীষ্ম মৌসুমের ১১ প্রজাতি, ইতস্তত ভ্রমণকারী পাখি ১৬৫ প্রজাতি ও চলার পথের পাখি (প্যাসেজ) বা চলাচলে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এমন প্রজাতি ১২টি।
সূত্রে আরও জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে এক সময় প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখির অবস্থান ছিল। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতি পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি বিচরণ করত এই হাওরে।

শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি যে সকল দেশী জাতের এবং পরিযায়ী পাখিরা টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাপ পাখি, বড় পানকৌরি, ছোট ডুবুরি, ধুপনি বক, বেগুনি বক, মেটে রাজহাঁস, ছোট সরালি, বড় সরালি, খুনতে হাঁস, পাটারি হাঁস, জিরিয়া হাঁস,ফুলুরি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, সিঁথি হাঁস, লাল ঝুটি ভুতি হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, পান্তা ঝিলি, মেটেবুক ঝিলি, নেউ পিপি, দলপিপি, কুট, লাল ঢেঙ্গা, মেটেমাথা টিটি, তিলা লালপা, লালপা, সবুজপা, বিল বাটান, সোনালি বাটান, কালোমাথা গাঙচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কুড়া, বড় চিত্রা ঈগল, তিলা নাগ ঈগল ইত্যাদি৷
এছাড়াও আগত পাখির মধ্যে রয়েছে, বিরল প্রজাতির মৌলভীহাঁস, পিয়ারী, সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গি বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা ও কুলাউ। লাল বুকের ক্লাইক্যাসার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। আসে স্বচ্ছ পানির খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস, বড় সারস, হেরন, নিশাচর হেরন, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন, গ্যাডওয়াল, নর্দান পিনটেইল, নর্দান সুবেলার, কমন পোচার্ড। টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা
নানা রং আর কণ্ঠবৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, রাজসরালি,পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল তিলি হাঁস, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। এছাড়া পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক আসে এই হাওড়ে। আসে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ল (দেশে এর নমুনা সংখ্যা ১০০টির মতো)।
টাঙ্গুয়ার হাওরে সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাঁস এবং কালোলেজ জৌরালি। দেশে দৃশ্যমান ৮টি বেয়ারের ভুঁতিহাঁসের মধ্যে ৫টিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়।
বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরও আছে কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,গতবছর(২০২৪ খ্রীস্টাব্দ) ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, ওয়ার্ল্ড বার্ড মনিটরিং ও বাংলাদেশ বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত পাখি শুমারির তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরে ৪৯ প্রজাতির ৪৩ হাজার ৫১৬ টি পাখি বিচরন করছিল।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার এর (আইইউসিএন) মূখ্য গবেষক ও লেখক সীমান্ত দীপু বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর পাখির জন্য নিরাপদ।এই হাওরে দেশে পরিযায়ী পাখির সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটে। মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে পরিযায়ী পাখি আসতে থাকবে। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরেএলাকায় পাখি শিকারি ও পর্যটকরা পাখি নিরাপদে থাকার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তাই টাঙ্গুয়াকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় জনগণসহ প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।

মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল রায় ভোরের কাগজকে বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করেছে। আমি ইতিমধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির অভয়াশ্রম বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিলে পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়িয়েছি। এছাড়া পাখি শিকারীদের ব্যাপারেও খোঁজ নিচ্ছি। তাদের পাখি শিকারের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য প্রশাসনের পক্ষথেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে।”
#

About Author Information

SYLHET JOURNAL

জনপ্রিয় সংবাদ

দিরাইয়ে বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা লিফলেট বিতরণের উদ্বোধন

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com

টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি

প্রকাশের সময় : 10:20:55 am, Saturday, 4 January 2025

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) থেকে:

অবশেষে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি। বৃহস্পতিবার(০২ জানুয়ারী) বিকেলে হাওর তীরবর্তী জনপদে আকাশ থেকে ভেসে আসে ভিন্ন ধরনের শোঁ শোঁ আওয়াজ।চলতি বছরে এইপ্রথম ঝাঁক বেঁধে আসতে দেখা গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরের মেহমান পরিযায়ী পাখিদের। স্থানীয়রা এসব পাখিদের আদরকরে ডাকেন অথিতি পাখি। পাখিদের আগমনে এই জনপদের নানা বয়সী মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে আনন্দ আর উচ্ছাসের।
বাংলাদেশে টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখির সর্বোচ্চ উপস্থিতি দেখা যায়। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুর দুইটি উপজেলা১২৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি হলেও এর ৬০-৬৫ ভাগ মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থিত। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপন্ন এ জলাভূমিটি রামসার নীতিমালা অনুযায়ী সংরক্ষিত এলাকা। সুন্দরবনের পরে এটি দ্বিতীয় রামসার সাইট।
তবে ভৌগলিক অবস্থান ও জলাভূমির জীব-বৈচিত্র্য, এর সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাস, বিশ্বের বিরল প্রজাতির পাখির আবাসস্থল, বিপুল সংখ্যক পরিয়ায়ী পাখীর উপস্থিতি, দূর্লভ জলজ বৃক্ষ গুল্মলতা রয়েছে এ সব বিবেচনায় ইউনেস্কো এ জলাভূমিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) টাঙ্গুয়ার হাওরে জীব-বৈচিত্র্য পুনোরুদ্ধারে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। সংস্থাটি টাঙ্গুয়ার হাওরের বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিল নামের দুইটি জলাশয় পরিযায়ী ও দেশীয় পাখির অভয়াশ্রম নির্ধারন করে কোর জোনের আওতাভুক্ত করেছে। এ দুইটি জলাশয় মধ্যনগর উপজেলার ভৌগলিক সীমায় অবস্থিত। প্রতি বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা পাখি দিনের বেলায় হাওরজুড়ে বিচরন করলেও সন্ধ্যায় বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিলে এসে নির্ভয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে।

পরিযায়ী পাখি মূলত তীব্র শীত ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল দূরের পথ উড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। ওরা আসতে শুরু করে নভেম্বরে। এপ্রিল পর্যন্ত থাকে। এবার প্রায় একমাস দেরীতে টাঙ্গুয়ার হাওরে এলো পরিযায়ী পাখি।

বিশ্বের যেসব দেশ থেকে পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে এর মধ্যে রয়েছে মঙ্গোলিয়া, চীন, তিব্বত, ভারত,নেপাল, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়া,ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ার, সাইবেরিয়া ও এন্টার্টিকা।

পাখি বিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতিগতভাবেই পরিযায়ী পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত। এরা সাধারণত ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। ছোট পাখিদের ঘণ্টায় গতি ৩০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে ওড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব পাখি তাদের গন্তব্যস্থান ঠিকভাবেই নির্ণয় করে। প্রতিটি পরিযায়ী পাখি গড়ে আট হাজার মাইল ভ্রমণ করে বাংলাদেশে আসে। এরা ২০০ থেকে ২৩০ দিন এ দেশে অবস্থান করে তারা। হাওর এলাকা এসব পাখির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। হাওরে দেড়-দুই লাখ পরিযায়ী পাখি আসে। যার সর্বোচ্চ পরিমান পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে অবস্থান নেয়।

পাখি গবেষক ও তাদের গবেষনা সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১ হাজার ৮৫৫ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এর মধ্যে হাঁস প্রজাতির ২৪টি, শিকারি পাখি ৩২টি, শীত মৌসুমের পাখি রয়েছে ২০০ প্রজাতি, গ্রীষ্ম মৌসুমের ১১ প্রজাতি, ইতস্তত ভ্রমণকারী পাখি ১৬৫ প্রজাতি ও চলার পথের পাখি (প্যাসেজ) বা চলাচলে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এমন প্রজাতি ১২টি।
সূত্রে আরও জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে এক সময় প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখির অবস্থান ছিল। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতি পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি বিচরণ করত এই হাওরে।

শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি যে সকল দেশী জাতের এবং পরিযায়ী পাখিরা টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাপ পাখি, বড় পানকৌরি, ছোট ডুবুরি, ধুপনি বক, বেগুনি বক, মেটে রাজহাঁস, ছোট সরালি, বড় সরালি, খুনতে হাঁস, পাটারি হাঁস, জিরিয়া হাঁস,ফুলুরি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, সিঁথি হাঁস, লাল ঝুটি ভুতি হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, পান্তা ঝিলি, মেটেবুক ঝিলি, নেউ পিপি, দলপিপি, কুট, লাল ঢেঙ্গা, মেটেমাথা টিটি, তিলা লালপা, লালপা, সবুজপা, বিল বাটান, সোনালি বাটান, কালোমাথা গাঙচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কুড়া, বড় চিত্রা ঈগল, তিলা নাগ ঈগল ইত্যাদি৷
এছাড়াও আগত পাখির মধ্যে রয়েছে, বিরল প্রজাতির মৌলভীহাঁস, পিয়ারী, সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গি বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা ও কুলাউ। লাল বুকের ক্লাইক্যাসার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। আসে স্বচ্ছ পানির খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস, বড় সারস, হেরন, নিশাচর হেরন, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন, গ্যাডওয়াল, নর্দান পিনটেইল, নর্দান সুবেলার, কমন পোচার্ড। টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা
নানা রং আর কণ্ঠবৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, রাজসরালি,পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল তিলি হাঁস, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। এছাড়া পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক আসে এই হাওড়ে। আসে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ল (দেশে এর নমুনা সংখ্যা ১০০টির মতো)।
টাঙ্গুয়ার হাওরে সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাঁস এবং কালোলেজ জৌরালি। দেশে দৃশ্যমান ৮টি বেয়ারের ভুঁতিহাঁসের মধ্যে ৫টিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়।
বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরও আছে কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,গতবছর(২০২৪ খ্রীস্টাব্দ) ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, ওয়ার্ল্ড বার্ড মনিটরিং ও বাংলাদেশ বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত পাখি শুমারির তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরে ৪৯ প্রজাতির ৪৩ হাজার ৫১৬ টি পাখি বিচরন করছিল।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার এর (আইইউসিএন) মূখ্য গবেষক ও লেখক সীমান্ত দীপু বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর পাখির জন্য নিরাপদ।এই হাওরে দেশে পরিযায়ী পাখির সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটে। মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে পরিযায়ী পাখি আসতে থাকবে। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরেএলাকায় পাখি শিকারি ও পর্যটকরা পাখি নিরাপদে থাকার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তাই টাঙ্গুয়াকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় জনগণসহ প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।

মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল রায় ভোরের কাগজকে বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করেছে। আমি ইতিমধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির অভয়াশ্রম বেরবেরিয়া বিল ও লেচুয়ামারা বিলে পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়িয়েছি। এছাড়া পাখি শিকারীদের ব্যাপারেও খোঁজ নিচ্ছি। তাদের পাখি শিকারের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য প্রশাসনের পক্ষথেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে।”
#