Sylhet 7:40 am, Wednesday, 22 January 2025

রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আগে সংসদ নির্বাচনের দাবি কেন? ড. যোবায়ের আল মাহমুদ

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের চলমান সংকটের সমাধান কোন পথে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে প্রথম থেকেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংসদীয় নির্বাচনেই সমাধান খুঁজছেন বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধা। অন্যদিকে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতেই সংসদীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছেন আরেক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা। তবে গণঅভ্যুত্থানকে চলমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে বিলীন করে দেওয়া ছিল ভুল।

একটা বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল এই অভ্যুত্থানের, সেটাকে উকিলি কায়দায় শেষ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে চলমান সংবিধানের অধীনে সব সমাধান খোঁজা। গণঅভ্যুত্থানকে বিজয়ী করতে হলে আমাদের দরকার তার রাজনৈতিক পরিণতির দিকে নজর দেওয়া। ফ্যাসিবাদী শাসনের কলকবজা উপড়ে ফেলে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা। তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। ব্যক্তির সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনসহ সব ঢেলে সাজানো। কিন্তু এসব না করেই পুরোনো সংবিধানের ভিত্তিতেই তড়িঘড়ি নির্বাচন দিয়ে সংসদ তৈরি করা আমাদের রাজনৈতিক সংকট দূর করতে পারবে না।

এই সংবিধানের অনেক ভালো দিক থাকলেও এখানে গণতন্ত্রের যে মূল কথা, মানে ব্যক্তির সার্বভৌম অধিকারের সুরক্ষার জন্য গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো ক্ষমতা-কাঠামো নেই। বরং সংসদ বা সরকারকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়ে যখন-তখন সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে কিংবা অবৈধ ইলেকশনে ক্ষমতাসীন হয়ে অথবা সামরিক কায়দায় ক্ষমতা দখল করে সংবিধানে নানা রদবদল করা হয়েছে, যার ফলে সংবিধান এখানে একটা ‘সাংবিধানিক কর্তৃত্ববাদ’ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়েই আছে। ক্ষমতাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই কেন্দ্রীভূত করা, তিন বিভাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখা, ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সাংসদদের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধাদান থেকে শুরু করে এ ধরনের প্রচুর বিধান আছে, যা স্বৈরাচারী শাসনের দিকেই নিয়ে যায় এই সংবিধান। যদিও এই সংবিধানে রাজনৈতিক ও মৌলিক মানবাধিকারের কিছু ধারা রয়েছে যেমন মতপ্রকাশের অধিকার এবং প্রতিবাদের অধিকারÑতবে এই অধিকারগুলো রক্ষার জন্য কার্যকর কোনো সুরক্ষা নেই।

এই সংবিধানে উল্লিখিত ক্ষমতার কাঠামোগুলো মূলত সরকারের স্থিতিশীলতাকে ব্যক্তির অধিকারের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যার ফলে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার সংবিধান প্রণয়নে যেমন এ দেশের জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে শুধু উকিলদের দিয়ে তা লেখা হয়েছে আইনি কিতাব আকারে, দেশের গঠনতন্ত্র আকারে নয়। তেমনি সংবিধানের সংশোধন বা পরিবর্তন করতে গণভোটের সুযোগ না থাকায় জনগণের অংশগ্রহণকে নাকচ করে দিয়ে তাদের ওপর চাপানো হয়েছে ‘সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র’। ফলে চলমান সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর ভর করে যে সংসদ ডাকা হবে, তাই সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার করবে এটার সম্ভাবনা কম।

সমস্যা হচ্ছে, এখন রাজনৈতিক দলগুলো মূলত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে নাকচ করতে চাচ্ছে। অথচ বিগত ১০ বছর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলেই একটা জবরদস্তিমূলক টোটালিটেরিয়ান শাসন মেনে নিতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। এখন আবার একই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে সংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়ে গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রকাঠামো অক্ষত রাখার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে সংবিধান অমান্য করেই। যেই সংবিধান নিজেই একটা অগণতান্ত্রিক শাসনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, তা মানলে অভ্যুত্থান হয় না।

রাজনীতিবিদরা দায়সারা গোছের সুপারফিশিয়াল সুগারকোটেড সংস্কার করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছেন বলেই এখন রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপ্লবিক রূপান্তরের বিরোধিতা করছেন। ফলে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন মানে চলমান ‘কর্তৃত্ববাদী’ সংবিধান স্থগিত করে নতুন সংবিধান তৈরির কাজে তাদের আগ্রহ কম। তাদের এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা হয় পরাশক্তিদের সঙ্গে বোঝাপড়ামূলক আপস থেকে অথবা ক্ষমতা কাঠামোর বৈপ্লবিক রূপান্তর তাদের নিজেদের জন্যই রাজনীতি করা এবং শাসনকাজ পরিচালনা করা কঠিন করে তুলবে এই ভয় থেকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের একক আন্দোলন ছিল না জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান। ফলে শুধু রাজনীতিবিদদের চাওয়াই আন্দোলনকারীদের চাওয়া হতে পারে না।

বাংলাদেশের এবারের গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো অভ্যুত্থান। অথচ এ রকম একটা সুযোগ আসার পরও যারাই দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য কাজ না করে খালি ক্ষমতার হাতবদলের কথা ভাবেন, তারা আসলে কতটুকু জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং অভিপ্রায় বুঝতে পারেন, তা আমার জানা নেই। তারা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ নামক একটা বিষয়কে হাইলাইট করে গণঅভ্যুত্থানকে ‘গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে রূপান্তরে বাধা দিচ্ছেন। নতুন গঠনতন্ত্র রচনা না করে দায়সারা গোছের শাসনতন্ত্র বজায় রাখার ফলে দেশ আবার পুরানা জীর্ণশীর্ণ কাঠামোতেই চলতে থাকবে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র অথবা ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ’র বিরুদ্ধে একটা গণরায়। ফলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার আলাপ আসলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।

অথচ ১৯৯০-এর মতো আমাদের এবার আর ভুল করার সুযোগ নেই। গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের দরকার ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং ফ্যাসিবাদী কাঠামোর মতো অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপ্লবিক সংস্কারের জন্য আগে সংবিধান সভার নির্বাচন দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা, যেখানে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের রূপরেখা থাকবে। তারপর নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতেই নির্বাচনের আয়োজন করা। দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের এই গণঅভ্যুত্থানকে শুধু ক্ষমতার পালাবদলের সিঁড়ি আকারে না দেখে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ আকারে দেখা উচিত। শুধু রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র পুনর্গঠন ছাড়া একটি সাধারণ নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে পারবে না।

এ দেশের রাজনীতিবিদরা তো গণভোট সিস্টেমই রাখেননি। তারা জনগণকে বাদ দিয়ে নিজেরাই দেশি-বিদেশি কিছু এজেন্সির সঙ্গে মিলেমিশে কিছু অনুগত বুদ্ধিজীবী উকিল দিয়ে গঠনতন্ত্র তৈরি করে। ফলে জনগণ এসব গঠনতন্ত্রের মূল ফোকাস নয়। জনগণকে শাসনের নামে তাদের গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করে রাখাই এসবের উদ্দেশ্য। যেমনÑ ১৯৭২-এ গণপরিষদ নির্বাচন স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি, ৭০-এর নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিদের দিয়েই সংবিধান সভা হয়েছে। ৭২-এর সংবিধান আবার গণভোটেও পাস করানো হয়নি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি বলেই বারবার এখানে গণঅভ্যুত্থান করতে হয়েছে জনগণকে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এখন যে সুযোগ এসেছে রাষ্ট্র গঠনের, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি আরও কঠিন হয়ে যাবে। আর রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনগণের রাজনৈতিক বাসনাকে গঠনতন্ত্রে রূপ দেওয়াই প্রথম পদক্ষেপ। এ কারণেই বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধান সভার প্রতিনিধি নির্বাচন বা গণপরিষদ নির্বাচন দরকার। তারপর এই প্রতিনিধিরা দেশের সব শ্রেণিপেশার লোকদের সঙ্গে ডায়ালগের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনা করে একটা খসড়া সংবিধান তৈরি করবে এবং আবার গণভোট দেবে। সেখানে পাস হলেই তারপর তা সংবিধান বা গঠনতন্ত্র আকারে গৃহীত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যে বারবার জনগণ তাদের পক্ষেই আছে, এই দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে নাকচ করে দিচ্ছে, তারা জনগণের রাজনৈতিক সংজ্ঞা না দিয়ে সামাজিক সংজ্ঞাকেই ফোকাস করছে। ধরেন সবাই তো জনগণের কথা বলে, কিন্তু কিছু লোকের সমষ্টি জনগণ নয়, যেমন মব মানে জনগণ নয়। তাহলে জনগণ হচ্ছে যারা গাঠনিক পাওয়ার (constitutive power) রাখে এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র ( constitution) তৈরির দাবি জানায়, কারণ এই গঠনতন্ত্রই হচ্ছে জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের লিপিবদ্ধ প্রকাশ। এই মুহূর্তে আমাদের রাষ্ট্র গঠনের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র তৈরির রাজনীতিকেই তাই সামনে নিয়ে আসতে হবে।

লেখক : চিন্তক এবং সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

About Author Information

SYLHET JOURNAL

জনপ্রিয় সংবাদ
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com

রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আগে সংসদ নির্বাচনের দাবি কেন? ড. যোবায়ের আল মাহমুদ

প্রকাশের সময় : 06:38:22 am, Saturday, 18 January 2025

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের চলমান সংকটের সমাধান কোন পথে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে প্রথম থেকেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংসদীয় নির্বাচনেই সমাধান খুঁজছেন বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধা। অন্যদিকে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতেই সংসদীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছেন আরেক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা। তবে গণঅভ্যুত্থানকে চলমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে বিলীন করে দেওয়া ছিল ভুল।

একটা বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল এই অভ্যুত্থানের, সেটাকে উকিলি কায়দায় শেষ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে চলমান সংবিধানের অধীনে সব সমাধান খোঁজা। গণঅভ্যুত্থানকে বিজয়ী করতে হলে আমাদের দরকার তার রাজনৈতিক পরিণতির দিকে নজর দেওয়া। ফ্যাসিবাদী শাসনের কলকবজা উপড়ে ফেলে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা। তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। ব্যক্তির সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনসহ সব ঢেলে সাজানো। কিন্তু এসব না করেই পুরোনো সংবিধানের ভিত্তিতেই তড়িঘড়ি নির্বাচন দিয়ে সংসদ তৈরি করা আমাদের রাজনৈতিক সংকট দূর করতে পারবে না।

এই সংবিধানের অনেক ভালো দিক থাকলেও এখানে গণতন্ত্রের যে মূল কথা, মানে ব্যক্তির সার্বভৌম অধিকারের সুরক্ষার জন্য গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো ক্ষমতা-কাঠামো নেই। বরং সংসদ বা সরকারকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়ে যখন-তখন সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে কিংবা অবৈধ ইলেকশনে ক্ষমতাসীন হয়ে অথবা সামরিক কায়দায় ক্ষমতা দখল করে সংবিধানে নানা রদবদল করা হয়েছে, যার ফলে সংবিধান এখানে একটা ‘সাংবিধানিক কর্তৃত্ববাদ’ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়েই আছে। ক্ষমতাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই কেন্দ্রীভূত করা, তিন বিভাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখা, ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সাংসদদের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধাদান থেকে শুরু করে এ ধরনের প্রচুর বিধান আছে, যা স্বৈরাচারী শাসনের দিকেই নিয়ে যায় এই সংবিধান। যদিও এই সংবিধানে রাজনৈতিক ও মৌলিক মানবাধিকারের কিছু ধারা রয়েছে যেমন মতপ্রকাশের অধিকার এবং প্রতিবাদের অধিকারÑতবে এই অধিকারগুলো রক্ষার জন্য কার্যকর কোনো সুরক্ষা নেই।

এই সংবিধানে উল্লিখিত ক্ষমতার কাঠামোগুলো মূলত সরকারের স্থিতিশীলতাকে ব্যক্তির অধিকারের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যার ফলে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার সংবিধান প্রণয়নে যেমন এ দেশের জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে শুধু উকিলদের দিয়ে তা লেখা হয়েছে আইনি কিতাব আকারে, দেশের গঠনতন্ত্র আকারে নয়। তেমনি সংবিধানের সংশোধন বা পরিবর্তন করতে গণভোটের সুযোগ না থাকায় জনগণের অংশগ্রহণকে নাকচ করে দিয়ে তাদের ওপর চাপানো হয়েছে ‘সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র’। ফলে চলমান সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর ভর করে যে সংসদ ডাকা হবে, তাই সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার করবে এটার সম্ভাবনা কম।

সমস্যা হচ্ছে, এখন রাজনৈতিক দলগুলো মূলত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে নাকচ করতে চাচ্ছে। অথচ বিগত ১০ বছর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলেই একটা জবরদস্তিমূলক টোটালিটেরিয়ান শাসন মেনে নিতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। এখন আবার একই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে সংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়ে গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রকাঠামো অক্ষত রাখার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে সংবিধান অমান্য করেই। যেই সংবিধান নিজেই একটা অগণতান্ত্রিক শাসনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, তা মানলে অভ্যুত্থান হয় না।

রাজনীতিবিদরা দায়সারা গোছের সুপারফিশিয়াল সুগারকোটেড সংস্কার করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছেন বলেই এখন রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপ্লবিক রূপান্তরের বিরোধিতা করছেন। ফলে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন মানে চলমান ‘কর্তৃত্ববাদী’ সংবিধান স্থগিত করে নতুন সংবিধান তৈরির কাজে তাদের আগ্রহ কম। তাদের এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা হয় পরাশক্তিদের সঙ্গে বোঝাপড়ামূলক আপস থেকে অথবা ক্ষমতা কাঠামোর বৈপ্লবিক রূপান্তর তাদের নিজেদের জন্যই রাজনীতি করা এবং শাসনকাজ পরিচালনা করা কঠিন করে তুলবে এই ভয় থেকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের একক আন্দোলন ছিল না জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান। ফলে শুধু রাজনীতিবিদদের চাওয়াই আন্দোলনকারীদের চাওয়া হতে পারে না।

বাংলাদেশের এবারের গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো অভ্যুত্থান। অথচ এ রকম একটা সুযোগ আসার পরও যারাই দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য কাজ না করে খালি ক্ষমতার হাতবদলের কথা ভাবেন, তারা আসলে কতটুকু জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং অভিপ্রায় বুঝতে পারেন, তা আমার জানা নেই। তারা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ নামক একটা বিষয়কে হাইলাইট করে গণঅভ্যুত্থানকে ‘গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে রূপান্তরে বাধা দিচ্ছেন। নতুন গঠনতন্ত্র রচনা না করে দায়সারা গোছের শাসনতন্ত্র বজায় রাখার ফলে দেশ আবার পুরানা জীর্ণশীর্ণ কাঠামোতেই চলতে থাকবে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র অথবা ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ’র বিরুদ্ধে একটা গণরায়। ফলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার আলাপ আসলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।

অথচ ১৯৯০-এর মতো আমাদের এবার আর ভুল করার সুযোগ নেই। গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের দরকার ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং ফ্যাসিবাদী কাঠামোর মতো অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপ্লবিক সংস্কারের জন্য আগে সংবিধান সভার নির্বাচন দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা, যেখানে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের রূপরেখা থাকবে। তারপর নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতেই নির্বাচনের আয়োজন করা। দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের এই গণঅভ্যুত্থানকে শুধু ক্ষমতার পালাবদলের সিঁড়ি আকারে না দেখে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ আকারে দেখা উচিত। শুধু রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র পুনর্গঠন ছাড়া একটি সাধারণ নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে পারবে না।

এ দেশের রাজনীতিবিদরা তো গণভোট সিস্টেমই রাখেননি। তারা জনগণকে বাদ দিয়ে নিজেরাই দেশি-বিদেশি কিছু এজেন্সির সঙ্গে মিলেমিশে কিছু অনুগত বুদ্ধিজীবী উকিল দিয়ে গঠনতন্ত্র তৈরি করে। ফলে জনগণ এসব গঠনতন্ত্রের মূল ফোকাস নয়। জনগণকে শাসনের নামে তাদের গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করে রাখাই এসবের উদ্দেশ্য। যেমনÑ ১৯৭২-এ গণপরিষদ নির্বাচন স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি, ৭০-এর নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিদের দিয়েই সংবিধান সভা হয়েছে। ৭২-এর সংবিধান আবার গণভোটেও পাস করানো হয়নি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি বলেই বারবার এখানে গণঅভ্যুত্থান করতে হয়েছে জনগণকে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এখন যে সুযোগ এসেছে রাষ্ট্র গঠনের, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি আরও কঠিন হয়ে যাবে। আর রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনগণের রাজনৈতিক বাসনাকে গঠনতন্ত্রে রূপ দেওয়াই প্রথম পদক্ষেপ। এ কারণেই বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধান সভার প্রতিনিধি নির্বাচন বা গণপরিষদ নির্বাচন দরকার। তারপর এই প্রতিনিধিরা দেশের সব শ্রেণিপেশার লোকদের সঙ্গে ডায়ালগের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনা করে একটা খসড়া সংবিধান তৈরি করবে এবং আবার গণভোট দেবে। সেখানে পাস হলেই তারপর তা সংবিধান বা গঠনতন্ত্র আকারে গৃহীত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যে বারবার জনগণ তাদের পক্ষেই আছে, এই দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে নাকচ করে দিচ্ছে, তারা জনগণের রাজনৈতিক সংজ্ঞা না দিয়ে সামাজিক সংজ্ঞাকেই ফোকাস করছে। ধরেন সবাই তো জনগণের কথা বলে, কিন্তু কিছু লোকের সমষ্টি জনগণ নয়, যেমন মব মানে জনগণ নয়। তাহলে জনগণ হচ্ছে যারা গাঠনিক পাওয়ার (constitutive power) রাখে এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র ( constitution) তৈরির দাবি জানায়, কারণ এই গঠনতন্ত্রই হচ্ছে জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের লিপিবদ্ধ প্রকাশ। এই মুহূর্তে আমাদের রাষ্ট্র গঠনের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র তৈরির রাজনীতিকেই তাই সামনে নিয়ে আসতে হবে।

লেখক : চিন্তক এবং সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়