রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ দোকানের ইন্টারনেট–সংযোগ, খাওয়ার পানি সরবরাহ ও ময়লা সরানোর কাজের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল সন্ত্রাসীরা। পাশাপাশি তারা চাঁদা হিসেবে নগদ অর্থ দাবি করেছিল। দুই দফায় গিয়ে তা না পেয়ে তারা বিপণিবিতানটির দুই ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করে।
১০ জানুয়ারি রাতে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে বিপণিবিতানটির ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে কুপিয়ে জখম করা হয়। একই সময় অপর ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল হাসানের গাড়িতে হামলা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় করা মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
৮–১০ জন মিলে এলোপাতাড়ি কোপ, বাঁচার আকুতি ব্যবসায়ীর
১১ জানুয়ারি ২০২৫
তিন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার যে বিষয়টি এসেছে, তদন্তে সেটিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এহতেশামুলকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার সময় সন্ত্রাসী দলের ১৫ থেকে ২০ জনের মতো উপস্থিত ছিল। আশপাশের বিভিন্ন স্থানে আরও ২০ জনের মতো অবস্থান নিয়েছিল। এই সন্ত্রাসীরা এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেটসহ আশপাশের এলাকা, ধানমন্ডির কিছু অংশের বিপণিবিতান, ইন্টারনেট, কেব্ল টিভির সংযোগ (ডিশ) ও ফুটপাতের চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
নিউমার্কেট থানায় মামলাটি করেন মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির নেতা ওয়াহিদুল হাসান। তিনি এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সমিতিরও সভাপতি। মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, এই মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন আসিফুল হক ওরফে আসিফ ওরফে ঝন্টু (৩২), মো. কাউসার মৃধা (২৪) ও এনামুল ওরফে মুরগি এনামুল। তাঁদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত আসামি। আর এনামুল সন্ত্রাসীদের তথ্যদাতা।
এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় ইমনকে ফাঁসানো হচ্ছে, দাবি মায়ের
মামলার প্রথম আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনসহ (৫২) অন্য গুরুত্বপূর্ণ আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের মধ্যে আছেন মুন্না, এ কে এম চঞ্চল ও জসিম ওরফে কলা জসিম।
এলিফ্যান্ট রোডের ২৪টি মার্কেটের কম্পিউটার ও এ-সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের নেতা ওয়াহিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্টোবরের দিকে প্রথমে চঞ্চল একদিন সাত থেকে আটজনকে নিয়ে আমার অফিসে আসেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কথা বলবেন বলে তাঁর ফোন আমাকে ধরিয়ে দেন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, “আমাদের ছেলেদের পাঠিয়েছি। ওরা যা বলে শুইনেন, ওদেরকে
দেখে রাইখেন।”’
মূলত এই ঘটনার পরই সন্ত্রাসীরা মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের দোকানগুলোর ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয় বলে জানান ব্যবসায়ী নেতা ওয়াহিদুল। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পর আরেক দিন কলা জসিম আসেন। তিনি ইমনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুন্নাকে ফোনে ধরিয়ে দেন। তখন ইন্টারনেট–সংযোগ, খাওয়ার পানি সরবরাহের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নগদ অর্থ দাবি করা হয়। এগুলো না দিলে সমস্যা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর হামলার ঘটনা ঘটে।’
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ১০ জানুয়ারি রাতে হামলার সময় চঞ্চল ও জসিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। মুন্নাকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। তবে তিনি হামলা-সংক্রান্ত একটি হোয়াটসঅ্যাপ আলোচনায় অংশ নেন। এ ঘটনার নেপথ্যে ইমনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এলিফ্যান্ট রোড এলাকার পাঁচ ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে চঞ্চল ও মুন্না এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। চঞ্চল নিউমার্কেট থানা যুবদলের নেতা।
১৪ জানুয়ারি চঞ্চলকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে যুবদলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) তারিক লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় অনেকগুলো বিষয় সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। যে তিন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার যে বিষয়টি এসেছে, তদন্তে সেটিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’
নিউমার্কেট থানার পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগার থেকে জামিনে বের হন। এর আগে তাঁর নামে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। তিনি জামিনে বের হওয়ার পর অসংখ্য অভিযোগ আসছে। ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ইমনের কোন পর্যায়ে যোগাযোগ ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও ইমনসহ মামলার আসামিরা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ। ইমনের মা ডা. সুলতানা জাহান গতকাল শনিবার সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ডিসেম্বরে (২০২৪) ইমন চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক গেছেন। এখনো তিনি সেখানে অবস্থান করছেন।
ইমন কীভাবে দেশত্যাগ করলেন, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে প্রশ্ন রয়েছে।
ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। আমি যখন সাহস করে কথা বললাম, মামলা করলাম, তখন অনেক ভুক্তভোগী আমার কাছে সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের কথা বলেছেন। মূল সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমি এখন নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’