নীলফামারীর ডিমলায় যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে ১৫০বিঘা কৃষি জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে বোরো ধানের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্য প্রচলিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে একই জাতের বীজ দিয়ে ট্রেতে বীজতলা তৈরি, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চারা রোপণ এবং কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মাধ্যমে কর্তন করার পদ্ধতিই হচ্ছে ''সমলয়''। ধান চাষে শ্রমিক সংকট নিরসন, উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ ও সময় বাঁচায় এ পদ্ধতি। ডিমলা উপজেলার কৃষকদের নিকট পদ্ধতিটি নতুন হলেও দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে। কৃষি বিভাগের মতে সমলয় পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশ খাদ্য উৎপাদনে আরও সমৃদ্ধ হবে। এছাড়া সমলয় পদ্ধতির চাষাবাদে বীজতলা তৈরি ও ধান মাড়াই যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে।
বুধবার (২২ জানুয়ারি) সকালে উপজেলা সদর ইউনিয়নের উত্তর তিতপাড়া গ্রামে (ভাটিয়াপাড়া) সমলয় পদ্ধতির মাধ্যমে চাষাবাদের উদ্বোধন করেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. এস. এম আবু বক্কর সাইফুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উপজেলা কৃষি অফিসার মীর হাসান আল বান্না।
অন্যান্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) জাকির হোসেন, অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) নিকছন চন্দ্র পাল, উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি অফিসার শামীমা ইয়াসমিন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মীর হাসান আল বান্না বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে ১১হাজার ২৫০হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে ১৫০বিঘা জমিতে সমলয়ে বোরো ধানের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। সমলয়ে চাষাবাদে আমরা উত্তর তিতপাড়া গ্রামের ৫০জন কৃষককে সম্পৃক্ত করেছি। তাদের জমিতে এ পদ্ধতির চাষাবাদ হচ্ছে। চাষাবাদের শুরুতে আমরা জমির উপরিভাগের মাটির সাথে জৈব সার সংমিশ্রণে ৪হাজার ৫০০টি প্লাস্টিকের ট্রেতে ধান বীজ বপন করা হয়। ২০থেকে ২৫দিনের মধ্যে এই বীজ চারা রোপণের জন্য উপযোগী হয়ে উঠে। এতে করে বাড়তি সারের প্রয়োজন হয় না। প্রতি বিঘায় প্রচলিত চাষাবাদে হাইব্রিড ধানবীজ ৪কেজি ও উফশী ধানবীজ ৬ কেজি দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হয়। সেখানে সমলয়ে চাষাবাদে বিঘাপ্রতি বীজ খরচ অর্ধেক হয়েছে। বীজে কৃষকের খরচ বেঁচেছে। এ চাষাবাদে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। এতে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে মাত্র ৫/৬শত টাকা, শ্রমিক দিয়ে ধান রোপণ করতে গেলে অন্তত চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হতো। জমিতে আগাছানাশক ব্যবহারের ফলে কৃষকের প্রায় ৭০শতাংশ শ্রমিক খরচ কমে যাবে। এক্ষেত্রে অন্তত ৮/১০জন শ্রমিকের মজুরি সাশ্রয় হবে। এ ধান পাকার পর কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে কেঁটে মাড়াই করে দেওয়া হবে। এ মেশিন দিয়ে ১ বিঘা জমির ধান কাঁটতে মাত্র ২হাজার থেকে ৩হাজার টাকা খরচ হবে। এতে সাশ্রয় হবে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এ পদ্ধতির চাষাবাদে কৃষকের বিঘাপ্রতি অন্তত ১০থেকে ১২হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া এ পদ্ধতির চাষাবাদে বিঘাপ্রতি হাইব্রিডে ২৪মণের স্থলে ৩৫মণ ধান উৎপাদিত হবে। উফশী জাতে ১৬-১৮মণের স্থলে ২৫-২৮মণ ধান উৎপাদন হবে।
ডিমলা সদর ইউনিয়ন ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান বলেন, আমার ব্লকের উত্তর তিতপাড়া এলাকায় রবি/২০২৪-২৫মৌসুমে সমলয় চাষাবাদে ৫০জন কৃষককে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সবকিছু যন্ত্রের মাধ্যমে হবে। তিনি আরও বলেন, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিন দিয়ে চারা একই গভীরতায় সমানভাবে লাগানো যায়। ফলে ফলনও বাড়ে। হাইব্রিড জাতের ধান চাষে বীজ বপনে ২৫দিন ও চারা রোপণে ১২০দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কৃষকেরা। এ সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষকেরা লাভজনক হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ভাটিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক মো. মমিনুর রহমান বলেন, এবার মেশিনের সাহায্যে ট্রেতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। এভাবে কখনো আবাদ করিনি। আর আগে জমি তৈরি করে ধানের বীজ লাগাইছিলাম। এ বছর কৃষি অফিস সরকারিভাবে বিনামূল্যে ব্রি ধান-৯২ ধানের বীজ দিচ্ছে, তা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিন দিয়ে লাগিয়ে দিচ্ছে আবার কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কেঁটেও দিবে। আশা করি ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
একই গ্রামের কৃষক মো. হাবিবুর রহমান (হাবীব) বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী কয়েক বিঘা জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষের প্রস্তুতি নিয়েছি। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে বীজতলা তৈরিতে অর্ধেক বীজ লেগেছে। এতে বীজ খরচ সাশ্রয় হয়েছে। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে ১ বিঘা জমির ধান আবাদ করেছি। এতে মাত্র ৬০০টাকা খরচ হয়েছে। এই পদ্ধতিতে খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন ধানের ফলনও ভালো হবে। তবে ভালো ফলন পেলে অধিক লাভবান হবে বলে আশা করছি।
উপপরিচালক ড. এস. এম আবু বক্কর সাইফুল ইসলাম জানান, সরকার কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে চাইছে। এ পদ্ধতির চাষাবাদ সম্প্রসারিত হলে দেশের খাদ্য উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে।