গণরোষের ভয়ে ১৪ দলীয় জোটের কোনো দলই নামছে না মাঠের কর্মসূচিতে। ১৯ বছরের পরম রাজনৈতিক আত্মীয়তায় ঘাটবাঁধা জোটের শীরক দলগুলো জুলাই বিপ্লবের পর চুপচাপ থাকলেও ভিন্ন ছদ্মাবরণে বিপ্লবের মধু আহরণে দেড় শতাধিক সংগঠনের দোকান নিয়ে মাঠে সক্রিয় গণআজাদী লীগের নেতারা।
১৫ বছর স্বৈরাচারের স্বাদ ভোগের পর গণআজাদী লীগ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে মাঠে নামলেও এরপেছনে কৌশলে কলকাঠি নাড়ছেন পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা। ভিন্ন কৌশলে শীরকদের ধীরে ধীরে মাঠে নামানোর চেষ্টা বলে তথ্য পেয়েছে সরকারের গোয়েন্দার সদস্যরাও।
সম্প্রতি আতা উল্লাহ খান অন্তর্বতী সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করলে আতার বিষয়ে অনুসন্ধানে মাঠে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
এতে আতার বিরুদ্ধে পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ রক্ষা করার তথ্যও পেয়েছে সংস্থাটি। নাম ও পদবী প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আতা উল্লাহ খানকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট উপর মহলের গ্রীন সিগনাল পেলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, বিগত ফ্যাসিবাদ শাসনের ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক গণ-আজাদী লীগ। দলটির সভাপতি আতা উল্লাহ খান কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে জন্ম। বিগত ৪ টি একতরফা সংসদ নির্বাচনে আতা ১৪ দলীয় জোটের নির্বাচনী সমন্বয়ক ছিলেন।
২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর শেখ হাসিনার দিল্লী সফরসঙ্গী ছিলেন তিনি। ১৪ দলীয় জোট তাকে গত ১ জানুয়ারি, ২০২৪ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক সংস্থা 'সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (সাঁকো)' এর প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে মনোনীত করে। এই অর্গানাইজেশন গত ৪ টি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করে। সাঁকোর নিবন্ধন নাম্বার ৫৫।
গত ডামি নির্বাচনে তার স্ত্রী রুবিনা আক্তার-কে ঢাকা-১০ আসনে তৃণমূল বিএনপির ব্যানারে নির্বাচনে নামিয়ে ছিলেন। নির্বাচন খরচ বাবদ স্বৈরাচারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছিলেন।
এছাড়াও আতা নাম স্বর্বস অন্তত দেড় শতাধিক সংগঠন গড়ে নিজে শীর্ষ পদে থেকে এবং বিভিন্ন ব্যানারে অনুষ্ঠান আয়োজন করে তার গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে খোঁজখবর নিয়ে অধিকাংশ সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন কিংবা কার্যালয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিপ্লবের পর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বহুরূপী আতা খান পরিচয় গোপন রেখে সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার পাশাপাশি বিপ্লবের স্বপক্ষের দলগুলোর নেতা এবং ডানপন্থি বুদ্ধিজীবীদের সাথেও সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে সরকারের ওই গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে।
নামস্বর্বস কমপক্ষে ১৫০ টিরও বেশি সংগঠন গড়ে ভিন্ন ভিন্ন ছদ্মাবরণে পরিচালনাও করছেন পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায়। তিনি বাংলাদেশ সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সভাপতি, কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান, আম্মা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক, সেভেন ওয়ান্ডার্স মিডিয়ার চেয়ারম্যান, মার্চ মিডিয়া লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আই পি টেলিভিশন জনতার টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল কর্ণফুলীর সিইও, আই পি টেলিভিশন ওনার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম-ভোক্তা অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি। তাছাড়া তর্কবাগীশ সাহিত্য পরিষদ, জাতীয় জাগো নারী ফাউন্ডেশন, জাতীয় নারী সাহিত্য পরিষদ ও গণ-আজাদী শিল্প গোষ্ঠীর প্রধান উপদেষ্টা-সহ বিবিধ নামসর্বস্ব সংগঠনের কর্ণধার এই বহুরূপী আতা উল্লাহ খান আতা। এসব সংগঠনের নামে চলছে তার নীরব চাঁদাবাজি।
এ ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয় অবৈধ উপায়ে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া কিছু দুর্নীতিবাজ ও বিগত সময়ের স্বৈরাচারের দোসরদেরকে। ঢাকা শহরের বাইরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক স্বৈরাচারের দোসর অর্ধশত মন্ত্রীর সঙ্গে যার সখ্যতা ছিল ওপেন সিক্রেট, যার বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচারের অভিযোগ দুদক-সহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এমন ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের নামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে সহ কিছু চিহ্নিত স্বৈরাচারের দোসরদেরকে অতিথি করা হয়। ভোল্ পাল্টানোর জন্য পাশাপাশি অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়- বিপ্লবের স্বপক্ষের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে।
শহীদ মঞ্জুর, আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে বিবিধ অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত; হাসিনা মমতাজ হাসী ও নাসরীন ইসলাম সেলীর বিরুদ্ধে স্বৈরাচারকে সহযোগিতা-সহ টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। আতা গংদের কাজ হলো এজাতীয় লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে টু-পাইস কামানোর জন্য।
আতা ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে অদ্যাবধি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মঞ্চ নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে ১০ দিন ব্যাপী একটি বিজয় মেলার আয়োজন করে আসছে। সংগঠনটির কাজ আওয়ামী লীগার ও শেখ পরিবারের সদস্যদের আদৌ মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও পরবর্তীতে বিরাট মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসে আছে তাদের পেট্রোনাইজ করা। এসব ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম হলো শিল্পী হাশেম খান (চাঁদপুর), সাদেক সিদ্দিকী (টাঙ্গাইল), এডভোকেট আসাদুজ্জামান (নারায়ণগঞ্জ)-সহ আরো বেশ কিছু লোক যারা মুক্তিযুদ্ধ না করেও এখন বিরাট মুক্তিযোদ্ধা সেজে আছে এবং অবৈধভাবে সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগ করছে দীর্ঘ ৫০ বছরেরও অধিক সময়কাল যাবত।
ধূর্ত আতা উল্লাহ খান আতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটিরও চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি বলে বেড়ান, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা হলো দেশের প্রধান সমস্যা। আর এই সমস্যার সমাধান কল্পে তিনি নন্ কমিউনাল ফ্রেন্ডস সোসাইটি নামক একটি সংগঠন গড়ে তুলে সেটার চেয়ারম্যান পদ দখল করে আছেন। আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ওটার সাধারণ সম্পাদকও তিনি।
অতি সম্প্রতি ‘বিদ্রোহী দি নজরুল সেন্টার’ নামে একটি কালচারাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যানের পদে আসীন হন এই আতা খান। যথারীতি এই সংগঠনেরও কোন রেজিষ্ট্রেশন নাই। এই সংগঠনের ব্যানারে আতার নেতৃত্বে কতিপয় ব্যক্তি জাতীয় কবির জন্মদিন উদযাপন, বিদ্রোহী কবিতা রচনার শতবর্ষ উদযাপন ইত্যাদি বহু শ্রুতি মধুর প্রোগ্রামের আয়োজন করে আর ক্রেস্ট প্রদানের নামে ব্যবসায়ী কাছ থেকে টুপ্রাইস নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। ধূর্ত আতা উল্লাহ খান আতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটিরও চেয়ারম্যান।
তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঐক্য হিসাবে ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। ২৩ দফা অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোটটির আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ওই বছরের ১৫ জুলাই থেকে। গত ১৯ বছরে নানা টানাপোড়েন এবং ভাঙাগড়া সত্ত্বেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জোটের শরিক দলের সংখ্যা ছিল আওয়ামী লীগসহ ১২টি। বাকি দলগুলোর মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, জাতীয় পার্টি-জেপি, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং কমিউনিস্ট কেন্দ্র।
সার্বিক বিষয়ে আতাউল্লাহ খান বলেন, ‘আমরা অনেকেই ছিলাম, সেটা কৌশলগত কারণে ছিলাম। পরে ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে সফরের পরপরই আমরা বেরিয়ে আসি। দেড়শতাধিক সংগঠন নিয়ে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে গঠিত একটি জোটের আমি সভাপতি। তবে কোথাও চাঁদাবাজির ঘটনা সঠিক নয়। টেক লাগানোর মতো আমার একাউন্টে কোনো টাকা নেই।’