ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। কথাগুলো ভালোভাবে মিলে যায় বাংলাদেশের এই অভিনেতার ক্ষেত্রে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অভিনয় ক্যারিয়ার ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। কিন্তু যাঁর পুরো সত্তার সঙ্গে মিশে আছে অভিনয়, তিনি কি আর অভিনয় ছেড়ে থাকতে পারেন। সেই পথ খুঁজতে গিয়েই তিনি নাম লেখালেন হলিউডে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেতাদের মতোই নিয়মিত ডলার পাচ্ছেন অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন।
এই অভিনেতা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার সিনেমায় নাম লেখানো খুবই কঠিন। যে কারণে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পীদের প্রভাবশালী সংগঠন ‘দ্য স্ক্রিন অ্যাক্টর গিল্ড-আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্টস’ (সেগ-আফট্রা) এর সদস্য। ‘আমি এখন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাক্টরস ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। যে কারণে এখন আমি হলিউডের মূলধারার সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ তৈরি করতে পারছি। এখন আমাকে হলিউডের কাজের জন্য ছুটতে হবে’, বলেন মিলন।
তাঁকে হলিউডের অভিনেতা হিসেবে নাম লেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘এম আর-৯: ডু অর ডাই’। মিলন বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছি। চেষ্টা করছিলাম এখানে অভিনয় করার। কারণ, আমাকে বছরের ৭০ ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রেই থাকতেই হবে। এখানে অভিনয়ের শুরুটা কঠিন। কারণ, ইউনিয়নগুলোর নিয়ম অনেক কড়া। আমাদের মতো এই ডাকল আর চলে গেলাম, সে রকম নয়। অভিনয়শিল্পীই আছেন কয়েক স্তরের। আমরা যেটাকে বলি এক্সট্রা চরিত্র, সাপোটিং চরিত্র—এগুলোর জন্য আলাদা নিয়মে মেম্বার হতে হয়। ভবিষ্যতের ভাবনা থেকেই আমি সদস্য হয়েছি।’
মিলন সরাসরি ‘সেগ-আফট্রা’–এর তালিকাভুক্ত পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবে নিবন্ধিত। কারণ, আগের ‘এম আর-৯: ডু অর ডাই’ সিনেমায় তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ‘আগের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা এবং যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থাকার কারণে এই সুযোগ পেয়েছি। এখানে আরও বেশ কিছু কারণ থাকে। সেগুলো আমার ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছে। যে কারণে আমি হলিউডের আরেকটি ছবি “বনইয়ার্ড”-এ একই ক্যাটাগরির শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছি’, বলেন মিলন।
সম্প্রতি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মাসে মাসে ডলার পাচ্ছেন’, এ প্রসঙ্গে কিছু বলবেন? এমন প্রশ্নে মিলন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমার অভিনয়শিল্পীরা ইউনিয়নের নিয়মমতো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে অভিনীত সিনেমার জন্য প্রতি মাসে সিনেমার আয় অনুযায়ী রয়্যালটি পান। এটি হলিউডের অ্যাক্টরস গিল্ডের তালিকাভুক্ত সবাই পান। সেভাবে আমিও এখন প্রতি মাসে একটা অর্থ পাই। এটা শিল্পীদের জন্য খুবই সম্মানের।’
মিলন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পীদের জন্য নানা নিয়ম থাকায় তাঁরা সারা জীবনই নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পেতে থাকেন। এমনকি এই সময়ে কোনো অভিনেতা শুটিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁর পাশে দাঁড়ায় সংগঠন। তাঁদের সব দায়দায়িত্ব সংগঠন নেয়। একটা বয়সের পরে কোনো শিল্পী বেকার থাকলে তাঁর পাশে দাঁড়ায়। ‘আমাদের দেশে এই নিয়মগুলো কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু এখানে শিল্পীদের জীবনযাপনটাই এসব কারণে আলাদা হয়ে থাকে। একজন সারা জীবন শৈল্পিক কাজের মধ্যেই থাকতে পারেন’, আক্ষেপ করে বলেন এই অভিনেতা।
একসময় শুটিংয়ের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া–আসা করলেও এখন তিনি স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। এই প্রসঙ্গে এই অভিনেতা বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও সন্তান আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রেই থাকত। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে বাচ্চা এখানেই পড়াশোনা করতে চায়, ওর ৮ বছর বয়স। যে কারণে তার সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আমি একেবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। আগে আমার স্ত্রী আমার ও সন্তানের জন্য সেক্রিফাইস করত। আমি দেশে অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে ছিলাম। এখন আমি দেশের ক্যারিয়ার ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সেক্রিফাইস করছি। এখন আমার বছরের ৭০ ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রেই কাটে। সন্তানের স্কুল ছুটির সময় অল্প দিনের জন্য দেশে আসা হয়। যে কারণে বাংলাদেশে অভিনয় ছেড়েই দিয়েছি বলা যায়।’
দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় বাংলাদেশের সিনেমার অনেক প্রস্তাব থাকলেও সেগুলো না করে দিতে হয়। তিনি জানান, ‘দাগি’সহ একাধিক সিনেমায় তাঁর অভিনয়ের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু করতে পারেননি। ‘যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রেই বেশি থাকতে হয়, সেহেতু পরিকল্পনাও সেভাবে করতে হচ্ছে। ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে এখানে লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি কলেজ থেকে ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করছি। আবার যুক্তরাষ্ট্রে অভিনয়ের ওপর কর্মশালা করাচ্ছি।’ মিলন আরও বলেন, ‘আমি চাইলেও দেশে থাকতে পারব না। যে কারণে নানা কিছুতে যুক্ত হচ্ছি। ছেলেকে সময় দিচ্ছি। অভিনয়ের জন্য নিজেতে তৈরি করছি। সবকিছুর পরও দেশের ক্যামেরার সামনে থাকা, থিয়েটার খুবই মিস করি।’
২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মিলনের স্ত্রী পলি আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকেই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন এই অভিনেতা। গত মার্চ মাসে তিনি অল্প সময়ের জন্য দেশে এসেছিলেন। এই সময়ে বিয়ে করেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম তানিয়া শারমীন শিপা। মিলন জানান, চেষ্টা করছেন স্ত্রীকেও যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে। সর্বশেষ তাঁকে ‘মায়া’ সিনেমায় দেখা গেছে। মিলন সবশেষে বলেন, ‘আগামী জুলাই থেকে আরও একটি হলিউডের সিনেমায় দেখা যাবে।’ তবে এটা নিয়ে আপাতত কিছুই জানাতে চান না তিনি।