ইসলামী দলগুলো ঐক্য গড়ছে

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী থেকে সমদূরত্ব রেখে ইসলামী দলগুলো একতাবদ্ধ হচ্ছে। মধ্যপন্থি দলগুলোকেও এতে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি এবং বড় দলগুলো কতটা ছাড় দেয়, তা দেখে ঠিক করবে– কার সঙ্গে জোট হবে। বিএনপি, জামায়াতের পর নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে।ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকতে পারবে না– ধরে নিয়েই এসব তৎপরতা চলছে। বড় জোট করে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া কিংবা একতাবদ্ধ থেকে সমঝোতার মাধ্যমে বিএনপির কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে ছাড় পাওয়া– দুটি লক্ষ্যই রয়েছে ইসলামী দলগুলোর।দ্রুত নির্বাচনের দাবি পূরণে বিএনপি কাছে টানলেও আগামী নির্বাচনে কতটা ছাড় দেবে, তা পরিষ্কার না করায় দলগুলো নিজেরা এক হচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপও চালাচ্ছে। ‘আদর্শিক বিরোধ’ থাকায় জামায়াতের সঙ্গে আলাপ চালিয়েও পিছিয়ে এসেছে তারা। এনসিপির সঙ্গে আলাপ চললেও দলটি এখনও ভোটের মাঠে শক্তিশালী না হওয়ায় তাদের সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ।হেফাজতে ইসলামের ঘনিষ্ঠ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলো ৫ আগস্টের পর থেকেই বলছে, আগামী নির্বাচনে লক্ষ্য ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে আনা’। ১৭ এপ্রিল খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি আলোচনার টেবিলে বসে একই লক্ষ্যের কথা বলেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও। ফলে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতের পর তারা ধর্মভিত্তিক দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। গত বুধবার সিদ্ধান্ত হয়, আগামী নির্বাচনে প্রতিটি আসনে সমমনা দলগুলোর সম্মিলিতভাবে একক প্রার্থী থাকবে। তবে যেখানেই যাক, এই পাঁচ দল একসঙ্গে থাকবে। দাবি করা হয়, প্রয়োজনীয় ও মৌলিক সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে।একই দিনে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদও। দু’দিন আগে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে একমত হয়েছিল দলটি। তবে বুধবার ইসলামী আন্দোলন ও গণঅধিকারের বৈঠকে ঐকমত্য হয়, সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন, সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচন এবং আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হতে হবে। বৈঠক শেষের দুই দাবিতে বিএনপির আপত্তি রয়েছে; তবে সমর্থন রয়েছে জামায়াতের।

যা হয়েছে কয়েক মাসে

দীর্ঘ আদর্শিক বিরোধ থাকলেও ২১ জানুয়ারি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সাক্ষাৎ হয়। বিএনপির একাধিক নেতা একে ‘স্বাধীনতাবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদের সহযোগীর মিলন’ আখ্যা দিয়ে কটাক্ষ করেন। কিন্তু পাঁচ দিন পর চরমোনাই পীরের সঙ্গে দেখা করতে ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ ১০ দফায় একমত হয়ে ঘোষণাপত্রে সই করে দল দুটি।এর আগে ২২ জানুয়ারি খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। তবে আগস্টে খেলাফত মজলিসসহ অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দল বৈঠক করে জামায়াতের সঙ্গে। গত ২৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফতের সম্মেলনে যোগ দিয়ে জামায়াতের আমির বলেছিলেন, ইসলামী দলগুলোর মাথায় আর কেউ কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে না। ১২ দলীয় জোট, সমমনা দলের সঙ্গে নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এখন অবশ্য প্রায় সব ইস্যুতে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তারা।৫ এপ্রিল হেফাজত নেতারা বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই খেলাফত মজলিস, জমিয়ত ও নেজামে ইসলামের নেতারা হেফাজতেরও জ্যেষ্ঠ নেতা। বৈঠকের পর বিএনপির তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য ঐকমত্য হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া হেফাজতের একাধিক নেতা একই ভাষ্য জানালেও সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী পরদিন জানান, নির্বাচন নিয়ে কথা হয়নি।৯ এপ্রিল এনসিপি কার্যালয়ে বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা। সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং জুলাই গণহত্যার বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতির দাবির সঙ্গে ঐকমত্য জানায় হেফাজত। ২০ এপ্রিল আবদুল বাসিত আযাদের নেতৃত্বাধীন খেলাফতের সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপি। মৌলিক সংস্কারের পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনসহ আট দফায় একমত হয় দল দুটি।আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেনি হেফাজত। তাই গত কয়েক মাসে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট দলগুলোও জামায়াত থেকে দূরে সরে গেছে। যদিও ৫ আগস্টের পর কাছাকাছি এসেছিল।

আগে একতা, পরে জোট 

নিবন্ধিত অপর দুই ইসলামপন্থি দল ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত আন্দোলনকেও সমমনা পাঁচ দলের মোর্চায় রাখা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। দল দুটি ডামি নির্বাচনখ্যাত ৭ জানুয়ারির ভোটে অংশ নেয়। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল হাসনাত আমিনী ও মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহকে ইতোমধ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোটের মতো খেলাফত আন্দোলনকেও ‘পরিশুদ্ধ’ করে আনা হবে বলে একাধিক নেতা জানিয়েছেন।মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফতের যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমিন সমকালকে জানিয়েছেন, বিএনপি ও জামায়াত থেকে সমদূরত্ব রেখে প্রথম লক্ষ্য নিজেদের একতা। পরে অন্য কারও সঙ্গে জোট হবে কিনা, তা নির্বাচনের আগের পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।৫ আগস্টের পর চরমোনাই পীরের দলের নেতারা চাঁদাবাজি, দখলের জন্য বিএনপিকে অভিযুক্ত করছে। বিএনপি শাসনামলের ব্যর্থতার ফিরিস্তি দিয়ে দলটি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া বলে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছে। সমমনা পাঁচ দল বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট করবে কিনা– প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে পাঁচ দল যা করবে, তা একসঙ্গে। যদি কোনো দলের সঙ্গে জোট হয়, সবাই মিলেই করবে। কেউ এককভাবে অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট করবে না।

কার সঙ্গে কে যাবে

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের ঘনিষ্ঠ একটি দলের নেতা সমকালকে জানান, আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ায় বিএনপির নির্বাচনী বিজয় প্রায় নিশ্চিত। ভোটের মাঠে বিএনপির চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা জামায়াতের কাছ থেকে ৫-১০ আসন ছাড় পাওয়ার চেয়ে বিএনপির কাছ থেকে এক-দুটি আসন পেলেও সংসদে যাওয়া অধিকতর নিশ্চিত। এ সমীকরণে দলগুলো বিএনপির দিকেই যাবে। ভোটের মাঠে এনসিপি জামায়াতের চেয়ে দুর্বল। এ দলটিকে কারও না কারও সঙ্গে জোট করতে হবে।জামায়াতের এক নেতা সমকালকে বলেন, ইসলামী দলগুলো একতাবদ্ধ হয়ে আসন সমঝোতার দরকষাকষিতে নিজেদের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে অতীতে দেখা গেছে, এসব জোট টেকে না। একেক দল একেক দিকে চলে যায়।জামায়াত ইসলামপন্থি হলেও তাদের মোর্চায় না রাখার বিষয়ে সমমনা একটি দলের জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, আবুল আলা মওদুদীর আদর্শ নিয়ে অরাজনৈতিক দেওবন্দ ঘরানার আলেম-ওলামাদের আপত্তি রয়েছে। তাই কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর পক্ষে জামায়াতের সঙ্গে জোট করা কঠিন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জোট হলেও তৃণমূলে পারস্পরিক ভোট বিনিময় আরও কঠিন।তিনি বলেন, এনসিপি এখনও দুর্বল। তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করতে পারে বলে মনে হচ্ছে। আবার বিএনপি নির্বাচনের প্রশ্নে ছোট দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য চাইলেও আসন ছাড়বে কিনা, স্পষ্ট করছে না। আশ্বাস দিয়ে পাশে রাখতে চাইছে। যেন সবাই বিএনপির সুরে কথা বলে। ইসলামপন্থিদের ইদানীং মৌলবাদী বলতে শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা। ইসলামী দলগুলো আর ব্যবহৃত হবে না। ইসলামপন্থিদের ভোট নিতে হলে মূল্য দিতে হবে বিএনপিকে।জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সব দলের সঙ্গে রয়েছে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ। জোট হবে কিনা; হলে কার সঙ্গে হবে– এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে নির্বাচনের বাতাস বইলে। এত আগে জোট করলে তা টেকসই হবে কিনা, এ চিন্তাও করতে হবে। জামায়াত ঐক্যের পক্ষে; কারও সঙ্গে সমস্যা নেই।

সুত্র: সমকাল