‘খুনি হাসিনা আমার ছেলের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে’

প্রকাশিত: ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫

‘খুনি হাসিনা আমার ছেলের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন এক দফায় পরিণত হয়, তখন তাতে যোগ দেন বগুড়ার শাওন ইসলাম। ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের দৃশ্য দেখে ঘরে বসে থাকতে পারেননি ২২ বছর বয়সি শাওন। বাবা-মায়ের অজান্তেই ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। সেখানে গুলির আঘাতে এখন পঙ্গুত্ববরণ করছেন।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলি ইউনিয়নের লক্ষ্মীকোলা কাজীপাড়া গ্রামের কৃষক সুলতান মিয়ার ছেলে শাওন ইসলাম। বাঘোপাড়া শহীদ দানেশ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের মানবিক শাখার ছাত্র শাওন। তিনি বলেন, ‘গুলির আঘাতে পঙ্গু হলেও খুনি হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এর থেকে মানসিক শান্তি আর নেই।’

শাওনের বাবা সুলতান মিয়া পেশায় একজন কৃষক। মা নাসিমা বেগম গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্য শাওন বড়। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল শাওন লেখাপড়া শেষে সরকারি চাকরি করে তাদের অভাব-অনটনের সংসারে সুখের হাল ধরবেন। কিন্তু গত জুলাই বিপ্লবে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন শাওন। এখন তিনি পঙ্গু অবস্থায় দিনযাপন করছেন। তবুও তার মনে কোনো কষ্ট নেই।

পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়েছে শুনে সবাই আনন্দ মিছিল নিয়ে বগুড়ার সাতমাথায় জড়ো হচ্ছিল। শাওনও সেই আনন্দ মিছিলের সঙ্গে যোগ দিয়ে মফিজ পাগলার মোড় থেকে বগুড়া সরকারি কলেজের কাছে যান।

সেখানে যাওয়া মাত্রই পুলিশের ছোড়া একটি গুলি এসে তার বাম পায়ে লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শাওন। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার একাংশ শাওনের গায়ে থাকা গেঞ্জি ছিঁড়ে গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থানটি বেঁধে দেন। বেশ কজন তাকে উদ্ধার করে বগুড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করায়।

সেখানে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় শাওনকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবার। সেখানেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠান। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশন করেন। শাওন সুস্থ হলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।

বন্ধ হয়ে গেছে লেখাপড়া। প্রায় ৬ মাস পেরোলেও এখনো তাকে হুইলচেয়ার ও ক্র্যাচের সাহায্যে চলাফেরা করতে হয়। ছেলের এমন দুর্দশা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন অসহায় মা-বাবা। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে বেদনা ও কষ্টের ছাপ।

বাবা সুলতান মিয়া আমার দেশকে বলেন, ‘ছেলে লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি করবে- এমন স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু খুনি হাসিনা ও তার পুলিশ বাহিনী আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। আমার ছেলে আর দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না ভেবে খুব কষ্ট পাই। ভবিষ্যতে কী করে খাবে—সেটা ভেবে রাতে ঘুম আসে না।’

মা নাসিমা বেগম বলেন, ‘এখনো রাতে ঘুমের মধ্য আমার ছেলে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে। প্রতি রাতে বুকে পাথরচাপা দিয়ে ও চোখের পানি ঝরিয়ে আল্লাহর কাছে খুনি হাসিনার বিচার চাই। মা হয়ে ছেলের এমন করুণ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন।

তবুও যখন দেখি শেখের বেটি পালিয়ে যাওয়ার ফলে দেশের মানুষ শান্তি ও মুক্তি পেয়েছে, তখন নিজেকে একজন ফ্যাসিস্টবিরোধী যোদ্ধার মা মনে করে গর্ববোধ করি। দেশ পুনরায় কালনাগিনী হাসিনার হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার পেছনে আমার ছেলের অবদান আছে ভেবে শান্তি পাই।’

আহত শাওন ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ‘যখন হাসিনার আমলে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষদের মুখে হাসির ঝিলিক দেখি, তখন পঙ্গুত্বের কষ্টকে আর কষ্ট মনে হয় না। কোটা আন্দোলনরত ছাত্র ভাইবোনদের ওপর নির্যাতন দেখে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারিনি। আমিও বিপ্লবে অংশ নিয়েছি। দেশকে পুনরায় স্বাধীন করেছি— এটাই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। কিন্তু আফসোস, আমি মা-বাবার স্বপ্ন আর পূরণ করতে পারব না।’

শাওন ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি সাহায্য চাই না। তবে সরকার যদি আমার যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে পরিবারের দারিদ্র্য ঘুচাতে একটু হলেও সহযোগিতা করতে পারতাম।’

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল